সোম দেবতা হিন্দুধর্মের বৈদিক যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। বেদে সোম দেবতার পরিচয় অত্যন্ত জটিল ও গভীর। সোম দেবতা শুধুমাত্র এক ধরণের দেবতা নন; তিনি একাধারে একটি পানীয়, একটি ঔষধি উদ্ভিদ, এবং দেবতাদের মধ্যেকার এক গুরুত্বপূর্ণ সত্তা। সোম শব্দের অর্থ চাঁদ বা মাধুর্যপূর্ণ রস। বৈদিক সাহিত্য অনুযায়ী, সোম একদিকে চন্দ্রদেব, অন্যদিকে স্বর্গীয় অমৃতের প্রতীক। তিনি দেবতাদের শক্তি প্রদান করেন এবং যজ্ঞের মধ্য দিয়ে ঋষিদের পবিত্র করেন।
সোমের বর্ণনা বেদে
ঋগ্বেদে সোমের মাহাত্ম্য
ঋগ্বেদের নবম মণ্ডল পুরোপুরি সোমকে উৎসর্গ করা হয়েছে। এখানে সোমকে “পবিত্র রস” বলে উল্লেখ করা হয়েছে যা যজ্ঞে ব্যবহৃত হয়। সোম উদ্ভিদের রস নিষ্কাশন করে সেটিকে প্রসাদ হিসেবে দেবতাদের নিবেদন করা হয়। ঋগ্বেদে সোমকে “পবিত্রতা, জীবনীশক্তি এবং অমৃত” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সোমের রস পান করে দেবতারা শক্তিশালী হন এবং অমরত্ব অর্জন করেন।
ঋগ্বেদের একটি শ্লোক:
“ইন্দ্র সোমপান করে অসীম শক্তি অর্জন করেন এবং অসুরদের বিনাশ করেন।”
এই শ্লোক থেকে বোঝা যায়, সোম দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ইন্দ্র সোমপান করে তাঁর যুদ্ধের শক্তি বৃদ্ধি করেন।
অথর্ব বেদে সোমের ঔষধি গুণ
অথর্ব বেদে সোম উদ্ভিদের ঔষধি গুণাবলী বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। এটি শুধু যজ্ঞে নয়, মানুষের রোগনিরাময়ের জন্যও ব্যবহৃত হত। অথর্ব বেদে বলা হয়েছে, সোম মানব শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং মানসিক স্থিরতা প্রদান করে।
সোম এবং চন্দ্রদেব
সোম শব্দটি চন্দ্রের সমার্থক। হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, চন্দ্রদেব হলেন সোমের ভৌতিক রূপ। চন্দ্রদেবকে “সোমরাজ” বলা হয়, যার অর্থ চন্দ্র হল দেবতাদের রাজার মতো। পুরাণে চন্দ্রকে ২৭টি নক্ষত্রের স্বামী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
চন্দ্রদেবের সঙ্গে সোমের সম্পর্কের একটি গল্প খুব জনপ্রিয়:
চন্দ্রদেব ব্রহ্মার পুত্র। তিনি অত্যন্ত মধুরভাষী এবং রূপে অতুলনীয় ছিলেন। কিন্তু চন্দ্রদেব যখন তাদের মধ্যে রোহিণীকে বেশি ভালোবাসতে শুরু করেন, তখন অন্য নক্ষত্ররা দুঃখিত হন এবং ব্রহ্মার কাছে অভিযোগ করেন। ব্রহ্মা তখন চন্দ্রকে অভিশাপ দেন। এই অভিশাপের ফলে চন্দ্র শুকাতে শুরু করেন। পরে সোমযজ্ঞের মাধ্যমে চন্দ্র পুনরায় পূর্ণতা লাভ করেন।
এই গল্পে সোমযজ্ঞের গুরুত্ব এবং চন্দ্রদেবের সঙ্গে সোমের সম্পর্ক ফুটে ওঠে।
সোম যজ্ঞ এবং বৈদিক সংস্কৃতি
সোম যজ্ঞ বৈদিক যুগের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় আচার। এই যজ্ঞে সোম উদ্ভিদের রস নিষ্কাশন করে সেটিকে পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে নিবেদন করা হয়। সোম যজ্ঞের মূল উদ্দেশ্য ছিল দেবতাদের সন্তুষ্ট করা এবং অমৃত লাভ করা।
সোম যজ্ঞে ব্যবহৃত সোম উদ্ভিদ কোথায় পাওয়া যায়, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কিছু পণ্ডিত মনে করেন, এটি হিমালয়ের একটি বিশেষ উদ্ভিদ। আবার অনেকে বলেন, এটি শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক রূপক।
সোমের বৈজ্ঞানিক দিক
সোম উদ্ভিদের ঔষধি গুণাগুণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে আজও গবেষণা চলছে। অথর্ব বেদে সোম উদ্ভিদের মাধ্যমে মানসিক শক্তি বৃদ্ধি ও রোগ নিরাময়ের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানেও কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ। বিশেষত, মানসিক উত্তেজনা কমানোর জন্য প্রাচীনকালে সোম উদ্ভিদ ব্যবহার করা হত বলে ধারণা করা হয়।
সোমের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আধ্যাত্মিকতা
সোম শুধুমাত্র একটি উদ্ভিদ বা পানীয় নয়; এটি আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক। বৈদিক যুগে মনে করা হত, সোম পান করলে মানুষ দেবতাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। সোম যজ্ঞের সময় যে মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়, তা আত্মাকে শুদ্ধ করে এবং মনে আধ্যাত্মিক জাগরণ ঘটায়।
সোমের আধ্যাত্মিক দিকটি একটি বৈদিক শ্লোকে প্রকাশ পেয়েছে:
“সোম আত্মার খিদে মেটায় এবং চেতনায় আলো জ্বালায়।”
সোমের ধর্মীয় কাহিনী
সোম এবং ইন্দ্রের সম্পর্ক
ইন্দ্র সোমকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। একটি কাহিনীতে বলা হয়েছে, একবার ইন্দ্র সমস্ত সোম পান করতে চেয়েছিলেন। এতে অন্যান্য দেবতারা ক্ষুব্ধ হন এবং সিদ্ধান্ত নেন, সোমকে শুধুমাত্র যজ্ঞের মাধ্যমে ভাগ করে নিতে হবে। এই গল্পে সোম দেবতার গুরুত্ব এবং দেবতাদের মধ্যে তাঁর অবস্থান ফুটে ওঠে।
সোম এবং ব্রিহাস্পতি
পুরাণে একটি কাহিনী রয়েছে যেখানে সোম ব্রহ্মার পুত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন। তিনি ব্রিহাস্পতির স্ত্রীর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাঁকে অপহরণ করেন। এতে ব্রিহাস্পতি ক্রুদ্ধ হয়ে সোমকে অভিশাপ দেন। পরবর্তীতে সোম তপস্যার মাধ্যমে মুক্তি পান। এই গল্প আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রতি সোমের নির্ভরতার একটি দৃষ্টান্ত।
উপসংহার
সোম দেবতা বৈদিক যুগের এক অমৃত সত্তা, যাঁর প্রভাব আজও আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানে টিকে রয়েছে। সোম কেবলমাত্র একটি পানীয় বা উদ্ভিদ নয়; তিনি আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক, দেবতাদের প্রিয় এবং মানব জীবনের পবিত্রতাকে আলোকিত করেন। বৈদিক মন্ত্র ও যজ্ঞে সোমের গুরুত্ব এক কথায় অপার। তাঁর মাধ্যমে আমরা দেবতাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারি এবং আধ্যাত্মিকতার পথে অগ্রসর হতে পারি।
পাঠকদের জন্য প্রশ্ন: আপনারা কি কখনও সোম সম্পর্কে শুনেছেন বা কোনো যজ্ঞে সোমের উল্লেখ দেখেছেন? আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না!