শত্রু, এই শব্দটি শোনার সাথে সাথেই আমাদের মন শক্ত হয়ে যায়। আমরা মনে করি, শত্রু মানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ক্রোধ বা প্রতিহিংসা। কিন্তু বৈদিক ধর্ম কি বলে? বৈদিক গ্রন্থগুলিতে কী শত্রুর প্রতি করুণা দেখানোর নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে? আপনি কি কখনো ভেবেছেন, করুণা এবং ক্ষমার মধ্য দিয়ে আমরা জীবনের উন্নতি করতে পারি? আসুন, আমরা বৈদিক ধর্মের আলোকে এই বিষয়ে গভীরে ডুব দিই।
বৈদিক শিক্ষার অন্যতম মূলভিত্তি
বৈদিক ধর্মে করুণা বা দয়া একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গুণ। “দয়া ধর্মের মূল”—এই শিক্ষা বার বার শাস্ত্রের বিভিন্ন অংশে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ঋগ্বেদ-এ বলা হয়েছে:
“মিত্রস্য চক্ষুষা সর্বাণি ভূতানি সামীক্ষন্তাম।”
(ঋগ্বেদ ৫.৬২.৯)
অর্থাৎ, সবাই যেন বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিতে একে অপরকে দেখে।
এই মন্ত্রে যে বার্তাটি দেওয়া হয়েছে তা হলো, পৃথিবীর প্রতিটি জীবের প্রতি করুণার দৃষ্টিতে তাকানো উচিত। এমনকি যদি কেউ আমাদের শত্রুও হয়, তবুও আমাদের দৃষ্টি যেন তাদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ থাকে।
শত্রুকে ক্ষমা করার গুরুত্ব
আমরা সবাই জানি, ক্ষমা একটি শক্তিশালী গুণ। কিন্তু শত্রুকে ক্ষমা করা কি সম্ভব? বৈদিক ধর্মে ক্ষমার শক্তি নিয়ে কী বলা হয়েছে? অথর্ববেদ-এ উল্লেখ রয়েছে:
“ক্ষান্তিরবলমশক্তানাম।”
(অথর্ববেদ ১২.১.৪৫)
অর্থাৎ, ক্ষমাই দুর্বলদের শক্তি।
আপনি যদি শত্রুর প্রতি করুণা দেখান, সেটি আপনার দুর্বলতা নয় বরং প্রকৃত শক্তি। একবার এক সাধু তার শিষ্যকে বলেছিলেন, “তুমি যদি তোমার শত্রুকে ঘৃণা করো, তবে তুমি তার মতোই নেতিবাচক শক্তির অংশ হয়ে যাবে। করুণা দেখাও, ক্ষমা করো, এবং দেখবে তুমি নিজেই মুক্তি লাভ করেছ।”
বাস্তব উদাহরণ: শত্রুর প্রতি করুণা
- রাজা হরিশচন্দ্রের কাহিনি:
রাজা হরিশচন্দ্র একবার শত্রুর হাতে পরাজিত হন। শত্রু তার সমস্ত রাজ্য কেড়ে নেয়। কিন্তু রাজা কখনো প্রতিহিংসার পথে হাঁটেননি। বরং করুণা এবং ধর্মের পথে থেকে তিনি তার রাজ্য পুনরুদ্ধার করেছিলেন। এটি প্রমাণ করে যে ধৈর্য এবং করুণা সবসময় সফলতার পথ তৈরি করে। - যুধিষ্ঠিরের আচরণ:
মহাভারতের যুদ্ধে, যুধিষ্ঠির তার চরম শত্রুদের প্রতিও করুণা দেখিয়েছিলেন। যখন দুর্যোধনের পতন হয়, তখন তিনি তাকে অপমান না করে বরং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। - গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা:
যদিও গৌতম বুদ্ধ বৈদিক ধর্মের পরবর্তী যুগের প্রতিনিধি, কিন্তু তার শিক্ষা ছিল শাস্ত্রের আদর্শের প্রতিফলন। তিনি বলেছিলেন, “ক্রোধ ক্রোধকে নাশ করতে পারে না, কেবল করুণাই ক্রোধকে জয় করতে পারে।”
বৈদিক ধর্মে করুণার ৪টি দিক
- শত্রুকে শিক্ষকের মতো দেখো:
“শত্রু” আমাদের জীবনের শিক্ষক হতে পারে। শত্রু আমাদের ধৈর্য, ক্ষমা এবং নম্রতা শেখায়। - শত্রুর প্রতি ভালোবাসা চর্চা করো:
ঋগ্বেদে বার বার ভালোবাসার শক্তি নিয়ে কথা বলা হয়েছে। - শত্রুকে পরিবর্তন করো:
করুণার মাধ্যমে শত্রুর মন পরিবর্তন করা সম্ভব। - নিজেকে মুক্ত করো:
শত্রুর প্রতি করুণা দেখানো মানে নিজেকে নেতিবাচক আবেগ থেকে মুক্তি দেওয়া।
আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিকতা
আপনি কি কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন যেখানে শত্রুর প্রতি করুণা দেখানো প্রয়োজন ছিল? হয়তো অফিসের কোনো সহকর্মী, কিংবা পরিবারের কারো সাথে মনোমালিন্য। এমন সময়ে করুণা দেখানোর চেষ্টা করুন। দেখবেন, আপনি নিজেও শান্তি অনুভব করছেন।
একটি প্রবাদ মনে পড়ে: “দয়া করা মানে শুধু অন্যকে সাহায্য করা নয়, এটি নিজেকে হালকা করা।” বৈদিক শিক্ষার এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের আধুনিক জীবনের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আপনি নিজেই উপলব্ধি করতে পারবেন।
একটি চূড়ান্ত প্রশ্ন
আপনি কি আজ থেকে শত্রুর প্রতি করুণা দেখানোর এই নীতি চর্চা শুরু করবেন? শাস্ত্রে যা বলা হয়েছে তা মেনে চলতে পারলে, আপনি নিজের এবং অন্যদের জীবন কতটা সুন্দর করে তুলতে পারেন?
“সর্বভূত হিতে রতা।”
(বগবদ গীতা ১২.৪)
সব জীবের মঙ্গল কামনা করার মধ্যেই জীবনের প্রকৃত সার্থকতা।
আজই শুরু হোক এই মহৎ চ