ভূমির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে বৈদিক ধর্ম কীভাবে উৎসাহ দেয়?

“মা ভূমি পুত্রো অহম পৃথিব্যাঃ” — “মা পৃথিবী আমার মা, আর আমি তার সন্তান।”
এই বৈদিক মন্ত্রটি আমাদের হৃদয়ে গভীর ভাবে প্রবেশ করিয়ে দেয় যে ভূমি শুধু একটি বস্তু নয়, তিনি আমাদের মা। অথচ, আমরা আধুনিক জীবনে এই সত্যটা প্রায় ভুলতে বসেছি। আজকের আলোচনায় আমি আপনাকে নিয়ে যাব সেই বৈদিক দর্শনের গভীরে, যেখানে পৃথিবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখা হয়েছে।

ভূমির গুরুত্ব: বৈদিক যুগের শিক্ষা

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, আমাদের অস্তিত্ব কীসের উপর দাঁড়িয়ে আছে? এই ভূমি আমাদের খাদ্য দেয়, জল দেয়, আশ্রয় দেয় এবং জীবনযাত্রার সমস্ত কিছু সরবরাহ করে। তাই বৈদিক যুগ থেকেই এই পৃথিবীকে মা রূপে পূজা করা হয়।

ঋগ্বেদের (R̥gveda) একটি বিখ্যাত শ্লোক আছে,

“পৃথিবী নোর্ভুর ভিষাণী তব বীজং সমুদ্রেষু স্থাপিতম্।”
অর্থ: “পৃথিবী আমাদের আশ্রয়স্থল, তাঁর বীজ সব সমুদ্রের গভীরে স্থাপন করা হয়েছে।”

এই শ্লোক আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ভূমি আমাদের প্রকৃত আশ্রয়দাতা। বৈদিক ঋষিরা পৃথিবীকে শুধু একটি পদার্থ বলে ভাবেননি, বরং তাঁকে জীবনদাত্রী হিসেবে পূজা করেছেন।

ভূমির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ: কিছু বৈদিক উদাহরণ

১. ভূমি পূজার ঐতিহ্য

প্রাচীন ভারতীয় সমাজে যেকোনো নতুন কাজের আগে ভূমি পূজা করা হতো। আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন “ভূমি পূজা” সম্পর্কে? বৈদিক ধর্মে কোনো জমিতে কৃষিকাজ শুরু করার আগে, নতুন গৃহনির্মাণের আগে কিংবা মন্দির স্থাপনের আগে ভূমিকে সম্মান জানানো হত। এই ভূমি পূজার মাধ্যমে আমরা পৃথিবী মায়ের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাই।

ঋগ্বেদে বলা হয়েছে:

“বৃক্ষা আদানং প্রাণানং ভিত্তিঃ”
অর্থ: “গাছপালা ও ভূমি আমাদের প্রাণের ভিত্তি।”

এই মন্ত্র আমাদের শেখায়, গাছপালা এবং ভূমির সঙ্গে যদি আমরা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখি, তবে আমাদের জীবনও সমৃদ্ধ হবে।

২. কৃষির গুরুত্ব এবং ভূমির প্রতি যত্ন

বৈদিক যুগে কৃষিকাজের সময় ভূমির প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া হত। তখন কৃষকরা বিশ্বাস করতেন যে ভূমি দেবী এবং তার উপর অযথা অত্যাচার করলে তিনি রুষ্ট হবেন।

কৃষির কাজ শুরু করার সময় “ভূমি সূক্ত” পাঠ করা হত। এখানে ভূমির প্রতি প্রশংসা করে বলা হয়েছে:

“তব গর্ভে অন্নং বহুধা প্রবৃদ্ধং তস্মাদাহারং জনঃ সমশ্নুতে।”
অর্থ: “তোমার (ভূমির) গর্ভে অন্ন উৎপন্ন হয়, এবং তা থেকে সমস্ত জীবের জীবনধারণ হয়।”

আপনি যদি কৃষিকাজ করেন কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার করেন, তাহলে এই শ্লোক আপনাকে শেখাবে কীভাবে ভূমিকে সম্মান জানাতে হয়।

৩. প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ভূমির প্রতি অবহেলা

বৈদিক যুগে মানুষের বিশ্বাস ছিল, যদি তারা পৃথিবীর প্রতি অবিচার করে, তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে ভূমি দেবী তার অসন্তোষ প্রকাশ করবেন। আজকের দিনে আমরা যে জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি, তা কি পৃথিবীর অসন্তোষেরই ইঙ্গিত নয়?

অথর্ববেদে বলা হয়েছে:

“মা তে ভূমে সহস্রাণি বিপ্রযন্তি পাপম্।”
অর্থ: “হে ভূমি, তোর উপর কোনো পাপ যেন না ঘটে।”

এই বাক্যগুলো আমাদের শিক্ষা দেয় যে ভূমির প্রতি অত্যাচার করলে তার ফল আমাদেরই ভোগ করতে হয়।

ভূমির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে আমাদের করণীয়

আপনি হয়তো ভাবছেন, “ভূমির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে আমরা কী করতে পারি?” বৈদিক ধর্ম অনুসারে কিছু সহজ পদ্ধতি রয়েছে:

১. গাছ লাগানো

বৈদিক যুগে বলা হত, একটি গাছ লাগানো মানে একটি জীবন সৃষ্টি করা। গাছপালা ভূমির উর্বরতা রক্ষা করে। আপনি যদি পৃথিবীকে উপহার দিতে চান, তবে একটি গাছ লাগান এবং তার যত্ন নিন।

২. ভূমির প্রতি অহিংস আচরণ

পৃথিবী আমাদের যেভাবে সাহায্য করে, আমরা তেমনভাবেই তাকে কষ্ট না দিয়ে ব্যবহার করতে পারি। প্লাস্টিক বর্জন, রাসায়নিকের কম ব্যবহার এবং জৈব কৃষির দিকে ঝুঁকলে পৃথিবী তার ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে।

৩. ভূমি পূজার প্রচলন ফিরিয়ে আনা

বৈদিক শাস্ত্রে যেমন ভূমি পূজা করা হত, তেমনভাবে আমাদেরও জীবনের ছোট-বড় কাজের শুরুতে ভূমিকে সম্মান জানানো উচিত।

৪. অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ থেকে বিরত থাকা

বৈদিক ধর্মে বলা হয়েছে,

“অতিশয় সঞ্চয়ঃ ভবতি ভূমির নাশঃ।”
অর্থ: “অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ করলে ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

এটি আমাদের শেখায়, প্রাকৃতিক সম্পদের সীমিত এবং দায়িত্বশীল ব্যবহার করতে হবে।

আমাদের দায়িত্ব: ভূমির প্রতি ভালোবাসা

আপনি জানেন কি? বৈদিক মন্ত্রগুলো শুধু আধ্যাত্মিক শিক্ষার জন্য নয়, এগুলো আমাদের বাস্তব জীবনের দিশাও দেখায়। আপনি যদি ভূমিকে ভালোবাসেন, কৃতজ্ঞতা জানান, তাহলে ভূমিও আপনাকে আশীর্বাদ দেবে। যেমন বীজ রোপণ করলে ফসল ফলায়, তেমনই পৃথিবীর প্রতি যত্নশীল হলে আপনার জীবনেও সমৃদ্ধি আসবে।

ঋগ্বেদের আরেকটি অনুপ্রেরণামূলক বাণী:

“যঃ ভূমিঃ স সখা ধ্রুভঃ।”
অর্থ: “ভূমিই আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু এবং ভিত্তি।”

শেষ কথা: ভূমির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে জীবনকে সমৃদ্ধ করুন

বন্ধু, আমাদের জীবন থেকে ভূমির অবদান কখনো মুছে ফেলা যাবে না। বৈদিক শাস্ত্রে ভূমিকে সম্মান করার যে দর্শন রয়েছে, তা আজকের যুগেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আপনি যদি প্রকৃত সুখ এবং শান্তি চান, তবে ভূমিকে সম্মান করুন, ভালোবাসুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *