জীববৈচিত্র্য—একটি শব্দ, কিন্তু এর গুরুত্ব কতটা গভীর, তা বুঝতে গেলে আমাদের পৃথিবীটাকে একটু ভালো করে দেখতে হবে। গাছপালা, পশুপাখি, নদী-নালা, পর্বত—সবকিছু একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে। আর এই জড়িয়ে থাকাটাই আমাদের জীবনধারণের মূল ভিত্তি। বৈদিক যুগে এ বিষয়টা যে কতটা ভালোভাবে বোঝা হয়েছিল, তা “ঋগ্বেদ,” “অথর্ববেদ,” “যজুর্বেদ” এবং “সামবেদ”-এর মন্ত্রগুলোর মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আজকের যুগে যখন আমরা জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি দেখে হতাশ হই, তখন বৈদিক শাস্ত্রের দিকে তাকালে আমরা অনেক সমাধান পেতে পারি। চলুন, আজ আমরা একসাথে সেই মন্ত্রগুলির সন্ধানে যাই।
বৈদিক শাস্ত্রে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব
আপনি কি জানেন, বৈদিক শাস্ত্রে প্রকৃতি এবং প্রাণিজগতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা একটি ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে দেখানো হয়েছে? ঋষিরা মনে করতেন, প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানই আমাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িত। গাছের ছায়া, নদীর পানি, পশুর সহায়তা—এসব ছাড়া কি আমরা বাঁচতে পারি? তাই তারা প্রকৃতির প্রতিটি জীব ও উপাদানের মধ্যে পরমাত্মার উপস্থিতি অনুভব করতেন।
ঋগ্বেদের একটি শ্লোক মনে করিয়ে দেয়:
“মাতা ভূমি: পুত্রোহং পৃথিব্যা:”
(অর্থ: পৃথিবী আমাদের মা, আর আমরা তার সন্তান।)
এই ভাবনাটিই জীববৈচিত্র্য রক্ষার মূলমন্ত্র। যদি আমরা পৃথিবীকে মা হিসেবে দেখি, তাহলে তার সন্তানদেরও (গাছ, পশু, নদী) আমাদের ভালোবাসা ও যত্নের প্রয়োজন।
১. গাছপালার গুরুত্ব: “বৃক্ষই জীবন”
বেদে গাছপালার কথা বারবার বলা হয়েছে। গাছ শুধু ছায়া দেয় না, জীবন বাঁচায়। “যজুর্বেদে” বলা হয়েছে:
“বনানাং বনপতয়ো নম:।”
(অর্থ: বনের দেবতাদের প্রতি আমাদের প্রণাম।)
বেদে গাছকে দেবতা রূপে সম্মান জানানো হয়েছে। কারণ গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে, অক্সিজেন দেয়। গাছপালার মৃত্যু মানে পৃথিবীর শ্বাসরুদ্ধ হওয়া। তাই আজকের যুগেও গাছ লাগানো এবং সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব।
আরও একটি বিষয়, “অথর্ববেদে” বলা হয়েছে:
“ওষধয়ঃ সম্ ভূতাঃ।”
(অর্থ: গাছপালা ওষধিরূপে আমাদের রোগমুক্ত করে।)
তাহলে ভাবুন তো, গাছের প্রতি অবহেলা কি আমাদের নিজের প্রতি অবহেলা নয়?
২. নদী এবং জলাশয়ের সংরক্ষণ: “জলই জীবন”
বৈদিক যুগে নদীকে দেবীরূপে পূজা করা হতো। আমরা সবাই জানি গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী ইত্যাদি নদীর কথা। কিন্তু জানেন কি কেন নদীকে এত সম্মান দেওয়া হতো?
“ঋগ্বেদ” বলে:
“আপো হি ষ্ঠা মায়োবু স্তনা উর্জে দধাতন।”
(অর্থ: হে জল, তুমি আমাদের আনন্দ এবং শক্তির উৎস।)
নদী বা জলাশয় শুধু আমাদের তৃষ্ণা মেটায় না, প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে। বৈদিক মন্ত্রে বারবার বলা হয়েছে, জলাশয়কে দূষিত করা মহাপাপ। আর বর্তমান সময়ে আমরা যদি নদীগুলোকে পরিষ্কার না রাখি, তাহলে সেই পাপের ফল আমাদেরকেই ভুগতে হবে।
৩. পশুপাখির সুরক্ষা: “পশুরাও আমাদের পরিবার”
“যজুর্বেদ” এবং “অথর্ববেদ”-এ গবাদি পশুদের গুরুত্ব অনেক বেশি। তখন গরু, ঘোড়া, ছাগল—এসব প্রাণী ছিল জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উৎস। কিন্তু সেই সঙ্গে তাদের প্রতি যত্ন এবং ভালোবাসা প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে।
“অথর্ববেদ” বলে:
“ধেনু: সদনং রয:।”
(অর্থ: গরু আমাদের সমৃদ্ধির আশ্রয়স্থল।)
গরুকে “ধর্মের প্রতীক” হিসেবে দেখানো হয়েছে। শুধু গরুই নয়, অন্যান্য পশুরাও প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে। আপনি কি জানেন, বাঘ বা সিংহের মতো শিকারি প্রাণী না থাকলে বনজীবন ধ্বংস হয়ে যাবে?
তাই বেদ বলে, প্রতিটি প্রাণীই দরকারি। আমরা তাদের হত্যা করলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবে।
৪. পরিবেশ দূষণ রোধ: “শুদ্ধতা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব”
বেদে পরিবেশকে শুদ্ধ রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
“ঋগ্বেদ”-এ বলা হয়েছে:
“শুচির্যন্তু ন: পবিত্রাণি।”
(অর্থ: পরিবেশকে পবিত্র রাখা আমাদের কর্তব্য।)
এটি কেবল বাহ্যিক শুদ্ধতার কথা বলে না, মন ও আত্মার শুদ্ধতার কথাও বলে। প্রকৃতি দূষিত হলে আমাদের মনও কলুষিত হয়ে যায়। তাই বায়ু, পানি, মাটি—সবকিছুকে পরিষ্কার রাখতে হবে।
৫. মাটির গুরুত্ব: “ভূমি আমাদের আশ্রয়”
“অথর্ববেদ”-এ পৃথিবীকে মায়ের রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। শ্লোকটি মনে রাখুন:
“ভূমির্ভূমনা ধ্রুতা।”
(অর্থ: পৃথিবী আমাদের শক্তির উৎস।)
আমরা যদি মাটিকে অবহেলা করি—অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করে চাষাবাদ করি বা বনভূমি কেটে ফেলি—তাহলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হবে। বেদ আমাদের মাটির সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখার শিক্ষা দেয়।
বৈদিক শিক্ষা কীভাবে জীবনে প্রয়োগ করা যায়?
প্রশ্ন আসতে পারে, “বেদের এই শিক্ষা তো হাজার বছর আগের, আজকের যুগে এগুলো কীভাবে প্রাসঙ্গিক?” উত্তরটা খুব সহজ।
- গাছ লাগান ও সংরক্ষণ করুন: প্রতি বছর অন্তত একটি গাছ লাগানোর প্রতিজ্ঞা করুন।
- জল সংরক্ষণ করুন: বৃষ্টির পানি ধরে রাখার উপায় বের করুন।
- পশুদের প্রতি দয়া করুন: তাদের জন্য খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করুন।
- পরিবেশ দূষণ রোধ করুন: প্লাস্টিক ব্যবহার কমিয়ে দিন এবং পুনর্ব্যবহারে জোর দিন।
- জীবনের সরলতা বজায় রাখুন: প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটান এবং আধ্যাত্মিক জীবনে মনোযোগ দিন।
শেষ কথা: প্রকৃতির সেবাই পরম ধর্ম
আজ আমরা আধুনিকতার দৌড়ে প্রকৃতিকে অবহেলা করছি। কিন্তু মনে রাখবেন, প্রকৃতি ছাড়া আমরা এক মুহূর্তও বাঁচতে পারব না। বৈদিক শাস্ত্র আমাদের জীববৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়।
একবার ভাবুন তো, যদি আমরা সবাই বেদের এই শিক্ষা মেনে চলি, তাহলে কেমন হবে পৃথিবীটা? পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা কি একটি সুন্দর পরিবেশ রেখে যেতে পারব না?