হিন্দু ধর্মের মূল ভিত্তি হলো বেদ। এই ধর্মের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বেদ চারটি ভাগে বিভক্ত—ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, এবং অথর্ববেদ। বেদে সত্য ও অসত্যের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটি কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বরং একটি নৈতিক ও জীবনদর্শনের শিক্ষা। আজকের এই আলোচনায় আমরা বেদ থেকে সত্য ও অসত্যের সংজ্ঞা এবং তার প্রভাব সম্পর্কে জানব।
সত্য ও অসত্য: বেদের মৌলিক সংজ্ঞা
বেদ অনুসারে, সত্য (সত্যম) হল যা চিরকাল স্থায়ী এবং যা বাস্তব। এটি সৃষ্টির মূল এবং চূড়ান্ত সত্য, যা পরমেশ্বর বা ব্রহ্মের সঙ্গে একীভূত। অপরদিকে, অসত্য (মিথ্যা) হল যা অস্থায়ী, পরিবর্তনশীল এবং যা প্রকৃত সত্যের থেকে বিচ্ছিন্ন।
ঋগ্বেদের একটি মন্ত্রে বলা হয়েছে:
“সত্যং চ অনৃতং চ সত্যং অভবৎ।”
অর্থাৎ, সত্য এবং অসত্যের মধ্যে সত্যই চূড়ান্ত। অসত্য সৃষ্টির অংশ হতে পারে, কিন্তু তা কখনো স্থায়ী নয়।
সত্যের বৈশিষ্ট্য বেদে
১. চিরন্তন সত্য:
বেদের মতে, সত্য হলো চিরন্তন। এটি পরিবর্তনহীন, এবং সময় বা স্থানের দ্বারা প্রভাবিত হয় না। যেমন ঈশ্বর, আত্মা এবং ধর্মের মৌলিক নীতি।
২. নৈতিক ও সঠিক আচরণ:
যা ধর্মময়, যা সৎ এবং যা সকলের মঙ্গলের জন্য কাজ করে, তাই সত্য। বেদে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে যে সত্য বলার এবং সত্য পথে চলার মাধ্যমেই মানুষ মোক্ষলাভ করতে পারে।
৩. ব্রহ্মের রূপ:
বেদে সত্যকে ব্রহ্মের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ঋগ্বেদের একাধিক স্থানে বলা হয়েছে, “সত্যং হি ব্রহ্মা।” অর্থাৎ, সত্যই ব্রহ্ম। এটি নির্দেশ করে যে সত্য হল সৃষ্টির মূল এবং ঈশ্বরের প্রকৃত রূপ।
অসত্যের বৈশিষ্ট্য বেদে
অসত্যকে বেদে অনিত্য, অস্থায়ী এবং মোহ বা মায়ার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
১. পরিবর্তনশীল:
বেদে অসত্যকে এমন কিছু বলা হয়েছে, যা কখনোই স্থায়ী নয়। যেমন, আমাদের ইন্দ্রিয়বোধ দ্বারা উপলব্ধ বিষয়গুলো। এগুলো শুধুমাত্র ক্ষণস্থায়ী।
২. মোহের সঙ্গী:
অসত্য মানুষের মনে মোহ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এটি মানুষকে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত করে।
৩. ধর্মের বিপরীত:
যে কোনো কাজ বা চিন্তা যা ধর্মের নিয়ম ভঙ্গ করে এবং যা মানুষের কল্যাণের পথে বাধা সৃষ্টি করে, তা অসত্য।
সত্য ও অসত্য সম্পর্কে একটি উপাখ্যান
বেদে সত্য ও অসত্যের ব্যাখ্যা বোঝার জন্য একটি জনপ্রিয় গল্প হলো “সত্যবান এবং সাবিত্রী”।
সাবিত্রী সত্যবানের প্রতি প্রেম অনুভব করে এবং তাঁকে বিয়ে করে, যদিও সে জানত যে সত্যবানের আয়ু সীমিত। যখন সত্যবানের মৃত্যু হয়, সাবিত্রী তার সততার এবং ভক্তির শক্তি দিয়ে যমরাজকে সন্তুষ্ট করেন। যমরাজ সাবিত্রীর অনুরোধে সত্যবানের প্রাণ ফিরিয়ে দেন।
এই গল্পটি দেখায় যে সত্য এবং ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা কেবল ব্যক্তি নয়, তার চারপাশের পরিবেশও পরিবর্তন করতে পারে। সাবিত্রী তার ভক্তি ও সত্যের মাধ্যমে যমরাজের মতো শক্তিকেও প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন।
বেদের নির্দেশ: সত্য পথে চলার গুরুত্ব
১. ঋগ্বেদ:
ঋগ্বেদের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে:
“সত্যং এষো ধর্মঃ।”
অর্থাৎ সত্যই ধর্ম। যারা সত্যপথে চলে, তারা সৃষ্টিকর্তার নিকট পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
২. অথর্ববেদ:
অথর্ববেদে সত্যের শক্তি ও তার প্রভাব সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে, সত্য হলো সমস্ত শুভ শক্তির উৎস। অসত্য যত বড়ই হোক, একসময় তা নিশ্চিহ্ন হয়।
৩. যজুর্বেদ:
যজুর্বেদে বলা হয়েছে, “সত্যং বধাৎ ধৃতি।” অর্থাৎ সত্যই মানুষকে ধৈর্যশীল এবং স্থিতিশীল হতে সাহায্য করে।
সত্য ও অসত্যের প্রভাব জীবনে
১. সত্যের প্রভাব:
- আত্মার শান্তি ও মুক্তি।
- সমাজে সুনাম এবং আস্থা অর্জন।
- জীবনে সাফল্য এবং দীর্ঘমেয়াদি সুখ।
২. অসত্যের প্রভাব:
- মোহ, বিভ্রান্তি এবং কষ্ট।
- আত্মার স্থায়িত্ব নষ্ট হয়।
- সামাজিক এবং নৈতিক অবনতি।
বর্তমান জীবনে সত্য ও অসত্যের শিক্ষা
আজকের আধুনিক যুগে সত্যের পথ অনুসরণ করা সহজ নয়। তবে বেদ আমাদের শেখায় যে, সত্যের পথে থাকা মানেই ঈশ্বরের পথে থাকা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, সত্য কথা বলা, সৎ পথে চলা, এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া—এগুলি সত্যের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
উপদেশ:
- সত্যকে সবসময় জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করুন।
- অসত্য বা মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- সত্যকে প্রায়োরিটি দিন, এমনকি যখন তা কঠিন হয়।
উপসংহার
বেদে সত্য এবং অসত্যের মধ্যে পার্থক্য শুধু ধর্মীয় বা দার্শনিক বিষয় নয়, এটি একটি জীবনদর্শন। সত্যের পথে চলার মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে মুক্তি বা মোক্ষলাভ করতে পারেন। হিন্দু ধর্মে বেদ আমাদের শেখায় যে, সত্য হলো চূড়ান্ত বাস্তবতা এবং অসত্য হলো মায়া।
প্রতিদিনের জীবনে যদি আমরা সত্যের শিক্ষা গ্রহণ করি, তবে আমাদের জীবন হবে শান্তি, আনন্দ এবং সাফল্যে পরিপূর্ণ।