বেদে কোন কোন নীতিমালা রাজাদের জন্য প্রযোজ্য ছিল?

হিন্দু ধর্মের প্রাচীনতম শাস্ত্র বেদে রাজনীতি এবং শাসনের গভীর ভিত্তি রয়েছে। বেদ শুধু ধর্মীয় বিষয় নিয়েই কথা বলে না, এটি সামাজিক ও নৈতিক শৃঙ্খলা, প্রশাসন এবং শাসকের দায়িত্ব সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা দেয়। বিশেষ করে ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ এবং অথর্ববেদে রাজাদের জন্য প্রযোজ্য নীতিমালা এবং শাসন পদ্ধতির উল্লেখ রয়েছে। এই নীতিগুলি সেই সময়ের শাসকদের কেবল শক্তিশালী শাসক হিসেবে গড়ে তুলত না, বরং ন্যায়ের ধারক এবং জনতার সেবক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করত।

আসুন, বেদের আলোকে রাজাদের জন্য প্রযোজ্য এই নীতিগুলি বিশদে আলোচনা করি।

 ধর্মের পথে রাজা: ন্যায়ের প্রতীক

বেদে বলা হয়েছে, রাজা হলেন ধর্মের অনুসারী এবং রক্ষক। রাজাকে তার শাসনকাজ ধর্মমতে পরিচালনা করতে হবে। ঋগ্বেদের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে:
“রাজা দেব: ধর্মেন প্রজা: রঞ্জয়তি।”
অর্থাৎ, একজন রাজা ধর্মের পথে চলেই প্রজাদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।

রাজাকে তার নিজের ইচ্ছা বা লালসা নয়, বরং ধর্মের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে হবে। একজন ন্যায়পরায়ণ শাসকই সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সক্ষম। মহাভারতের যুগে যুধিষ্ঠির এই নীতির আদর্শ উদাহরণ ছিলেন। তিনি ধর্মরাজ নামে পরিচিত ছিলেন কারণ তিনি কখনও ধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি।

 প্রজাদের সুরক্ষা: রাজধর্মের প্রধান দায়িত্ব

বেদের মতে, রাজা হলেন প্রজাদের রক্ষক। ঋগ্বেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে বলা হয়েছে, “প্রজাসংরক্ষণমে রাজধর্ম:”। অর্থাৎ, রাজধর্মের প্রধান দায়িত্ব হলো প্রজাদের সুরক্ষা দেওয়া।
এই নীতির ভিত্তিতেই প্রাচীন ভারতীয় রাজ্যগুলি গড়ে উঠেছিল। রামায়ণে আমরা দেখতে পাই, রাজা রামের শাসনে অযোধ্যায় কোনো ভয় বা অশান্তি ছিল না। তিনি সর্বদা তার প্রজাদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে কাজ করতেন।

 শাসনকাজে ন্যায্যতা এবং সততার আদর্শ

বেদে রাজাদের জন্য সততা এবং ন্যায্যতা রক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। যজুর্বেদের এক শ্লোকে বলা হয়েছে:
“সত্যমেব জয়তে নানৃতম।”
অর্থাৎ, সত্যই জয়ী হয়, মিথ্যা কখনও টিকে থাকে না।

রাজাকে শাসনকার্যে সবসময় সত্যনিষ্ঠ হতে হবে। এই নীতি কেবল প্রজাদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে না, বরং রাজ্যের প্রতি তাদের আস্থা বৃদ্ধি করে। মহাভারতে দ্রৌপদীর সভায় দুর্যোধন এবং যুধিষ্ঠিরের মধ্যেকার পার্থক্য সত্য ও মিথ্যার সংঘাতকেই তুলে ধরে।

 প্রজাদের সঙ্গে সদাচরণ এবং নিকট সম্পর্ক

বেদে প্রজাদের সঙ্গে রাজাদের সম্পর্ককে পিতা এবং সন্তানের সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যজুর্বেদের এক অংশে বলা হয়েছে:
“রাজা জনকস্য ন্যায়েন প্রজাসু প্রতিপালয়তি।”
অর্থাৎ, পিতা যেমন তার সন্তানদের যত্ন নেয়, তেমনই রাজাকেও তার প্রজাদের প্রতি একই মমতা ও দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন করতে হবে।

রাজা দাশরথ এই নীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি তার প্রজাদের সুখ-দুঃখকে নিজের মনে করতেন। এমনকি, রামের বনবাসের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ও তিনি প্রজাদের দুঃখে মর্মাহত হন।

 ধন সম্পদের সঠিক ব্যবহার

বেদে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজ্যের সম্পদ ব্যক্তিগত ভোগের জন্য নয়। এটি প্রজাদের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। ঋগ্বেদের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে:
“ইষে তে ভোগা: প্রজাহিতায়।”
অর্থাৎ, রাজ্যের ধনসম্পদ কেবল প্রজাদের মঙ্গলের জন্য ব্যয় করা উচিত।

রাজা অশোক এই নীতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর তিনি উপলব্ধি করেন, যুদ্ধ শুধুমাত্র ধ্বংস ডেকে আনে। এরপর তিনি তার সম্পদ প্রজাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং ধর্মীয় কাজে ব্যয় করেন।

 সামরিক শক্তি এবং ন্যায়ের ভারসাম্য

যজুর্বেদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রাজাকে সামরিক শক্তি বজায় রাখতে বলা হয়েছে, কিন্তু তা কখনই অত্যাচারের হাতিয়ার হবে না।
“শত্রুন্ সংহারতি ধর্মেণ।”
অর্থাৎ, শত্রুকে দমন করতে হলে তা ন্যায় এবং ধর্মমতে করতে হবে।

এই নীতির ভিত্তিতে রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তার রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। তিনি কৌশল এবং ন্যায়নীতির মিশ্রণ ঘটিয়ে তার শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করেছিলেন।

 শিক্ষা ও জ্ঞান লাভের গুরুত্ব

বেদের মতে, একজন রাজাকে সর্বদা জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী হতে হবে। ঋগ্বেদের শ্লোকে বলা হয়েছে:
“জ্ঞানেন রাজা প্রজাহিতায় শোভত।”
অর্থাৎ, জ্ঞানের মাধ্যমেই রাজা তার প্রজাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে পারেন।

রাজা জনক এই নীতির অনুসারী ছিলেন। তিনি একজন যোগী এবং বিদ্যানুরাগী ছিলেন। তার সভায় অসংখ্য ঋষি এবং পণ্ডিতরা জ্ঞান চর্চা করতেন।

 শত্রুর প্রতি ক্ষমাশীলতা

যজুর্বেদে বলা হয়েছে, রাজাকে সদয় হতে হবে। এমনকি শত্রুর প্রতিও তাকে ক্ষমাশীল হতে হবে।
“ক্ষান্তি: রাজসা শোভা।”
অর্থাৎ, ক্ষমাই রাজার অলংকার।

মহাভারতে আমরা দেখতে পাই, যুধিষ্ঠির দুঃশাসনের সমস্ত অপমান সত্ত্বেও তাকে ক্ষমা করেছিলেন। এটি তার মহৎ হৃদয়ের পরিচায়ক।

 প্রজাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া

বেদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রজাদের মতামত গ্রহণ করা। অথর্ববেদে উল্লেখ রয়েছে:
“সমগ্র প্রজাসংঘো রাজ্যে অংশী।”
অর্থাৎ, রাজ্যের প্রতিটি প্রজা রাজ্য পরিচালনায় পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে।

রাজা হরিশচন্দ্র এই নীতির এক অনন্য উদাহরণ। তিনি সর্বদা তার প্রজাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন এবং তাদের সমস্যার সমাধান করতেন।

 আত্মনিয়ন্ত্রণ ও অহংকারবর্জন

বেদে রাজাদের জন্য অহংকার পরিত্যাগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। রাজাকে তার কামনা-বাসনা এবং রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়েছে। ঋগ্বেদের একটি শ্লোকে বলা হয়েছে:
“অহংকারোহং সর্বনাশকর:”।
অর্থাৎ, অহংকারই সর্বনাশ ডেকে আনে।

এই নীতির অভাবেই দuryোধনের পতন ঘটেছিল, যেখানে রাম অহংকার বর্জন করে সত্যের পথে অটল থেকেছিলেন।

বেদের নীতিমালাগুলি শুধু প্রাচীন সময়ের জন্যই প্রাসঙ্গিক ছিল না; আধুনিক যুগেও এই নীতিগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। রাজা বা শাসক কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে বেদের নির্দেশনা আজও শিক্ষণীয়। ধর্মের পথে থাকা, প্রজাদের কল্যাণ করা, সত্যনিষ্ঠ হওয়া এবং ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে শাসনকাজ পরিচালনা করা—এই গুণাবলিই একজন শাসককে প্রকৃত অর্থে মহান করে তোলে।

আধুনিক শাসকদের জন্য বেদের এই শিক্ষাগুলি এক আলোকবর্তিকার মতো, যা ন্যায়ের পথে শাসন পরিচালনায় দিশা দেখায়। বেদের এই অমর নীতিগুলি আমাদের চিরকালীন ঐতিহ্যের অংশ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মূল্যবান শিক্ষা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *