বেদে করুণার সংজ্ঞা কী?

হিন্দু ধর্মে বেদকে জ্ঞানের পরম উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। বেদ থেকে আমরা জীবনের গভীরতম অর্থ, ধর্মীয় নীতি ও আত্মার মুক্তির পথ খুঁজে পাই। বেদের অমৃতবাণী আমাদের শুধু ধর্মীয় জ্ঞানই দেয় না, বরং নৈতিকতা, করুণা ও মানবতার পথ দেখায়। আজ আমরা বেদে করুণার সংজ্ঞা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব এবং বুঝতে চেষ্টা করব করুণার গভীর তাৎপর্য।

করুণার অর্থ ও তাৎপর্য

হিন্দু ধর্মে ‘করুণা’ শব্দটি অত্যন্ত পবিত্র এবং তাৎপর্যপূর্ণ। করুণা মানে হলো অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও সমব্যথা অনুভব করা। এটি এমন এক মানসিক অবস্থা, যেখানে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভুলে গিয়ে অন্যের দুঃখ-কষ্ট দূর করার চেষ্টা করা হয়।

বেদে করুণার মূল ধারণা হলো সমস্ত প্রাণীর প্রতি মমতা এবং তাদের দুঃখ লাঘব করার জন্য নিজেকে নিবেদন করা। এটি শুধু মানবজাতির প্রতি নয়, বরং সমস্ত জীবের প্রতি সমানভাবে প্রযোজ্য।

বেদের করুণা নিয়ে উক্তি ও শ্লোক

বেদের বিভিন্ন অংশে করুণার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:

ঋগ্বেদ (১০.১৯১.২):

“সম গচ্ছ ধ্বম সম বদ ধ্বম সম বো মনাঙ্কিৎতম।”
এই শ্লোকে সমতা ও মৈত্রীর গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে, যা করুণার একটি প্রধান দিক।

যজুর্বেদ (৩৬.১৮):

“মিত্রস্য চক্ষুষা সর্বাণি ভূতানি সংদৃশ্যাম।”
এখানে বলা হয়েছে, পৃথিবীর সব জীবকে মিত্রের দৃষ্টিতে দেখো। এই দৃষ্টিভঙ্গি করুণার ভিত্তি তৈরি করে।

অথর্ববেদ (১৯.৪৯.৫):

“মাতৃমান পিতৃমান আচার্যবান পুরুষঃ।”
এখানে করুণার সঙ্গে সম্মান এবং দায়িত্ববোধের সম্পর্ক উল্লেখ করা হয়েছে।

করুণার গল্প: ভগবান রামের উদাহরণ

হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রামায়ণে, ভগবান রামের জীবনে করুণার অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায়। তিনি শুধু একজন আদর্শ রাজা ছিলেন না, বরং এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, যাঁর মধ্যে করুণার এক অনন্য প্রকাশ ঘটেছে।

যখন ভগবান রাম বনবাসে ছিলেন, তখন তিনি শবরী নামে এক ভক্তের কাছে গিয়েছিলেন। শবরী অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন, কিন্তু রামের জন্য তিনি বনের ফল সংগ্রহ করেছিলেন। সেই ফলগুলোর প্রতিটিই তিনি নিজে চেখে দেখেছিলেন, যাতে রামের জন্য কোনো তিক্ততা না থাকে। শবরীর প্রতি রামের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত মমতাপূর্ণ। তিনি শবরীর দান গ্রহণ করে দেখিয়েছিলেন, কীভাবে শ্রদ্ধা এবং করুণার মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

করুণার মহত্ত্ব: মহাভারতের উদাহরণ

মহাভারতেও করুণার অসাধারণ উদাহরণ পাওয়া যায়। একটি বিখ্যাত ঘটনা হলো ভীষ্মের কথন। যখন ভীষ্ম শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিলেন, তখন তিনি নিজের কষ্ট ভুলে যুধিষ্ঠিরকে ধর্মের মূলনীতি শেখাচ্ছিলেন। তিনি বলেছিলেন:

“ধর্মের মূল করুণা। যদি করুণা না থাকে, তবে ধর্ম অর্থহীন।”

ভীষ্মের শিক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায়, করুণা মানব জীবনের এক অন্যতম নীতি, যা সমস্ত ধর্মীয় কর্মকাণ্ডকে অর্থবহ করে তোলে।

হিন্দু ধর্মে করুণার গভীরতা: প্রাণীদের প্রতি দয়া

বেদের শিক্ষা অনুযায়ী, সমস্ত প্রাণীর প্রতি দয়া করা করুণার একটি বড় দিক। এই দয়া কেবল মানবজাতির প্রতি সীমাবদ্ধ নয়। মনুস্মৃতি-তে উল্লেখ করা হয়েছে:

“অহিংসা পরম ধর্ম।”
অর্থাৎ, অহিংসাই ধর্মের শ্রেষ্ঠ রূপ। যখন আমরা কোনো প্রাণীকে কষ্ট দিই না এবং তাদের রক্ষার চেষ্টা করি, তখনই আমরা করুণার প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করি।

আধুনিক জীবনে করুণার ব্যবহার

আজকের যুগে করুণার শিক্ষাকে কীভাবে জীবনে প্রয়োগ করা যায়, তা ভাবা গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দু ধর্মের শিক্ষা অনুযায়ী:

  • সহানুভূতিশীল হওয়া: অন্যের দুঃখ-কষ্ট বুঝে তাদের পাশে দাঁড়ানো।
  • সেবা করা: ধর্মীয় বিশ্বাসে সেবা করাকে এক বিশাল পূণ্যকর্ম হিসেবে দেখা হয়।
  • প্রকৃতির প্রতি মমতা: বৃক্ষরোপণ, নদী রক্ষা এবং পরিবেশ সুরক্ষার মধ্য দিয়ে করুণার চর্চা করা।

করুণার পুরস্কার: ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ

হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, করুণার মাধ্যমে মানুষ ঈশ্বরের কাছে পৌঁছাতে পারে। ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন:

“যে ব্যক্তি সমস্ত জীবের প্রতি করুণাময় এবং অহংকারহীন, আমি তার কাছে সর্বদা উপস্থিত থাকি।”

করুণা ঈশ্বরের প্রেম ও আশীর্বাদ লাভের পথ খুলে দেয়। এটি জীবনের সমস্ত নৈতিক মূল্যের ভিত্তি।

করুণার প্রতিফলন: দৈনন্দিন জীবনে

আপনি কীভাবে করুণাকে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে পারেন?

  • অসহায় মানুষকে সাহায্য করুন।
  • প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করুন।
  • প্রাণী বা প্রকৃতির প্রতি সদয় হোন।
  • দানের মাধ্যমে সমাজের দুর্বল শ্রেণির পাশে দাঁড়ান।

করুণার চিরন্তন গুরুত্ব

করুণা হলো এমন এক গুণ, যা মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানবিক করে তোলে। এটি ঈশ্বরের প্রতিফলন এবং জীবনের এক উচ্চতর লক্ষ্য। হিন্দু ধর্মের বেদ ও গ্রন্থগুলো করুণাকে মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

শেষ কথা:
হিন্দু ধর্মে করুণা শুধু একটি গুণ নয়; এটি ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর একটি মাধ্যম। বেদের শিক্ষা অনুযায়ী, আমরা যদি করুণার পথ অনুসরণ করি, তবে আমরা কেবল নিজেদের নয়, পুরো সমাজকে এক নতুন আলোর পথে নিয়ে যেতে পারব। তাই, আসুন বেদের করুণার মহত্বকে জীবনে বাস্তবায়িত করি এবং সকলের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *