যদি আমরা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আদর্শ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তবে বৈদিক শাস্ত্র আমাদের জন্য একটি আদর্শ পথ নির্দেশ করে। বৈদিক দর্শনে, একজন শাসকের মূল দায়িত্ব হল নিজের প্রজাদের কল্যাণ সাধন করা এবং সমাজে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের সুষম বিকাশ নিশ্চিত করা। এই চারটি লক্ষ্য—যা একত্রে পুরুষার্থ চতুষ্টয় নামে পরিচিত—যে কোনো সুশাসনের ভিত্তি।
সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব: ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা
বৈদিক শাস্ত্রে “ধর্ম” শব্দটি কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি ন্যায়, সততা, এবং সর্বজনীন নীতির প্রতীক। অথর্ববেদ বলে:
“ধর্মো বিশ্বস্য জগतः প্রতিষ্ঠা” (অথর্ববেদ ১.৩.২২)
অর্থাৎ, “ধর্মই সমগ্র বিশ্বজগতের ভিত্তি।”
আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, একটি রাষ্ট্র তখনই সঠিকভাবে পরিচালিত হয় যখন এর শাসক ধর্মের পথে পরিচালিত হন। একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক কখনো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন না এবং প্রতিটি নাগরিকের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করেন। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন ভারতের রাজা হরিশচন্দ্র, যিনি তার প্রতিটি কর্মে সত্যের প্রতি অবিচল ছিলেন। তার শাসনকালে জনগণ কখনো অন্যায়ের শিকার হয়নি।
আপনাদের মধ্যে যদি কেউ একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হতে চান, তবে আপনাদের অবশ্যই ধর্মের মুল্যবোধকে ধারণ করতে হবে। কারণ, সমাজে ধর্ম প্রতিষ্ঠা কেবল সরকারের নয়, প্রতিটি নাগরিকেরও দায়িত্ব।
অর্থনৈতিক সুরক্ষা: প্রজাদের সুখী রাখার মাধ্যম
বৈদিক দর্শনে সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল অর্থনৈতিক সুরক্ষা প্রদান করা। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং প্রজাদের জীবিকার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা একটি শাসকের অপরিহার্য কাজ।
ঋগ্বেদ বলে:
“দাতা দেবং জনায় ত্রাতারমন্নম।”
অর্থাৎ, “একজন শাসকের দায়িত্ব হল তার প্রজাদের জন্য অন্ন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা।”
উদাহরণস্বরূপ, রাজা অশোকের শাসনামলে জনগণের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। এমনকি পশুদের জন্যও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
আপনারা যদি সমাজে উন্নতি চান, তবে নিশ্চিত করুন যে আপনার স্থানীয় সরকার জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলি পূরণ করছে। এবং আপনি নিজেও এই প্রচেষ্টার অংশ হতে পারেন—একটি উন্নততর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে।
শিক্ষার প্রসার: প্রকৃত জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেওয়া
উপনিষদ বলে:
“সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে।”
অর্থাৎ, “যে জ্ঞান মুক্তি এনে দেয়, তাই বিদ্যা।”
সরকারের দায়িত্ব হল এমন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা যা কেবল চাকরির উপযোগী নয় বরং প্রকৃত মুক্তি এবং মানসিক উন্নয়নের জন্যও সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ, চাণক্য (কৌটিল্য) তার শিক্ষানীতিতে বলেন, “প্রজাদের প্রকৃত শক্তিশালী করতে হলে তাদের শিক্ষায় দক্ষ করে তুলতে হবে।”
আপনারা নিজেরা কি এমন শিক্ষার প্রচার করছেন যা আপনার জীবন এবং অন্যের জীবনকে উন্নত করতে সাহায্য করে? বৈদিক শাস্ত্র অনুসারে, প্রকৃত জ্ঞান একমাত্র মানুষের আত্মাকে উন্নত করতে পারে।
পরিবেশ রক্ষা: প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষা
বৈদিক গ্রন্থে পরিবেশের গুরুত্ব বারবার উচ্চারিত হয়েছে। অথর্ববেদ বলে:
“মাতা ভূমিঃ পুত্রো অহং পৃথিব্যাঃ।”
অর্থাৎ, “পৃথিবী আমার মা এবং আমি তার সন্তান।”
একজন শাসকের দায়িত্ব হল পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন ভারতে, রাজারা বৃক্ষরোপণ এবং জল সংরক্ষণের মতো কাজকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
আপনিও কি আপনার পরিবেশ রক্ষার জন্য কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন? প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা কেবল সরকারের নয়, আপনারও দায়িত্ব।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: একটি সুশৃঙ্খল সমাজ গঠন
ন্যায়বিচার একটি সুশাসনের প্রধান স্তম্ভ। মনুস্মৃতি বলে:
“যো রক্ষতি সর্বং নীতি ধর্মেন স রাজা।”
অর্থাৎ, “যিনি ন্যায়বিচার ও ধর্মের মাধ্যমে সবাইকে রক্ষা করেন, তিনিই প্রকৃত রাজা।”
রাজা রামচন্দ্রের কথা ভাবুন, যিনি তার শাসনকালে ন্যায়বিচারের জন্য পরিচিত ছিলেন। তার শাসনে, ধনী ও দরিদ্র সবাই সমানভাবে বিচার পেয়েছিল।
আপনি যদি ন্যায়বিচারের জন্য আওয়াজ তোলেন, তবে আপনি একটি শক্তিশালী এবং সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ে তুলতে পারবেন।
একটি ভাবনা
বৈদিক শাস্ত্র আমাদের দেখায় যে একটি সরকারের মূল দায়িত্ব হল ধর্ম, অর্থ, কাম, এবং মোক্ষের সুষম উন্নতি নিশ্চিত করা। এই দায়িত্ব পালন করতে হলে শাসক এবং জনগণের মধ্যে একটি দৃঢ় সম্পর্ক থাকা জরুরি।