ধর্ম শব্দটি শুনলেই আমাদের মননে আসে এক ধরনের পবিত্রতা, ন্যায়, এবং সত্যের বাণী। কিন্তু আপনি কী কখনও ভেবে দেখেছেন, একজন সত্যিকারের ধার্মিক ব্যক্তি ঠিক কেমন হওয়া উচিত? আপনি যদি নিজেকে ধার্মিক বলে ভাবেন বা হতে চান, তবে আসুন, আমি আপনাকে কিছু পথ দেখাই যা ভেদশাস্ত্র থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়।
ধার্মিকতার মূলে কী?
প্রথমে আমরা বুঝে নিই, ধার্মিকতা মানে শুধুই আচার-অনুষ্ঠান বা রীতি মেনে চলা নয়। এটি মূলত একটি জীবনধারা। ভেদগুলোতে বলা হয়েছে:
“ধর্মস্তু সক্ষাৎ ভগবৎ প্রণীতম” – অর্থাৎ, প্রকৃত ধর্ম সেই, যা ঈশ্বর নির্দেশিত। তাই ধার্মিকতার মূল হলো সত্য, করুণা, এবং ন্যায়ের প্রতি আপনার অটল বিশ্বাস।
একজন ধার্মিক ব্যক্তির প্রধান বৈশিষ্ট্য
১. সত্য ও সৎ জীবনযাপন
আপনি হয়তো জানেন, “সত্যমেব জয়তে” – সত্যই জয়লাভ করে। একজন ধার্মিক ব্যক্তি কখনও মিথ্যা বলবেন না, কারণ মিথ্যার মাধ্যমে জীবনে হয়তো সাময়িক সুবিধা পাওয়া যায়, কিন্তু তা কখনই স্থায়ী সুখ দিতে পারে না।
আপনার জীবন সত্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি হলে, আপনি যেমন মানসিক শান্তি পাবেন, তেমনি আপনার আশেপাশের মানুষের কাছে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হবেন। ধরুন, এক ব্যবসায়ী তার গ্রাহকদের সঙ্গে সবসময় সৎ থাকে। এই সততার জন্য, তার ব্যবসা হয়তো ধীরে বাড়বে, কিন্তু তা স্থায়ী ও সম্মানের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে।
২. সহানুভূতি ও দয়া
“দয়া ধর্মের মূল” – দয়া ছাড়া ধার্মিকতা অসম্পূর্ণ। আপনি যদি প্রকৃত ধার্মিক হতে চান, তবে আপনার হৃদয়ে দয়া থাকা আবশ্যক। শুধু নিজের পরিবারের প্রতি নয়, সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রতিও আপনার দয়া থাকতে হবে।
একটি উদাহরণ হিসেবে ধরুন, রাস্তায় একটি ক্ষুধার্ত শিশুকে দেখলেন। আপনি যদি তাকে একটি খাবারের প্যাকেট দেন, সেই মুহূর্তে আপনি ধার্মিকতার একটি বড় বৈশিষ্ট্য দেখালেন।
৩. ক্ষমাশীলতা
“ক্ষমা বীরস্য ভূষণম” – ক্ষমা হলো বীরের অলংকার। ক্ষোভ বা প্রতিশোধের পথে না গিয়ে যদি আপনি কারও ভুল ক্ষমা করতে পারেন, তাহলে আপনি সত্যিকারের ধার্মিক। এটা শুধু অন্যকে নয়, আপনাকেও মানসিক শান্তি দেবে।
একবার এক ব্যক্তি গুরু নানকের কাছে গিয়ে তাকে অপমান করেছিলেন। গুরু নানক তাকে হাসিমুখে ক্ষমা করেন। সেই ব্যক্তি পরে বুঝতে পারেন তার ভুল এবং গুরু নানকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল হন। এটাই ক্ষমার শক্তি।
৪. নিরহংকার মনোভাব
“মা ফলেষু কদাচন” – ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, কাজ করো, কিন্তু তার ফলের জন্য লোভ কোরো না। একজন ধার্মিক ব্যক্তি কখনও অহংকার করবেন না। তিনি জানেন, যা কিছু তিনি অর্জন করেছেন, তা ঈশ্বরের আশীর্বাদ।
আপনি যদি জীবনের প্রতিটি সাফল্যকে ঈশ্বরের কৃপা বলে মনে করেন, তাহলে অহংকার আপনার মন থেকে দূরে থাকবে।
৫. ভক্তি ও আত্মনিবেদন
ধার্মিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ঈশ্বরের প্রতি আপনার ভক্তি। ভেদগুলোতে বলা হয়েছে:
“যঃ সর্বাণি ভুতানি আত্মন্যেবানুপশ্যতি” – যে ব্যক্তি সর্বত্র ঈশ্বরকে দেখতে পান, তিনিই প্রকৃত ধার্মিক।
আপনি যদি ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করেন এবং তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন, তবে আপনার জীবনের সব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে।
ভেদ থেকে আরও কয়েকটি শিক্ষা
- “আহিংসা পরম ধর্মঃ” – অহিংসা হলো সর্বোচ্চ ধর্ম। তাই সব জীবের প্রতি ভালোবাসা রাখুন।
- . “তেষামেব চ শাস্ত্রাণি” – শাস্ত্র অনুসারে জীবনযাপন করুন। এটি আপনাকে সঠিক পথ দেখাবে।
- “ধার্মিকো বিজয়ী ভবেত” – ধার্মিক ব্যক্তি সবসময় বিজয়ী হন। হয়তো তা সময় নেবে, কিন্তু প্রকৃত ধার্মিক কখনও পরাজিত হন না।
বাস্তব জীবনে এই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রয়োগ করবেন কীভাবে?
আপনার জন্য কয়েকটি সহজ প্রস্তাবনা:
- প্রতিদিন সকালে কয়েক মিনিট সময় নিয়ে ধ্যান করুন। ধ্যানের মাধ্যমে আপনি সত্যের সাথে যুক্ত হতে পারবেন।
- প্রয়োজনে দান করুন, কিন্তু তা প্রচার করার জন্য নয়।
- নিজের ভুল স্বীকার করুন এবং তা সংশোধন করার চেষ্টা করুন।
- অহংকার ও লোভ ত্যাগ করুন।
শেষ কথা
আপনি যদি নিজের জীবনে সত্যিকারের ধার্মিকতার বৈশিষ্ট্যগুলো গড়ে তুলতে চান, তবে আজ থেকেই ছোট ছোট পদক্ষেপ নিতে শুরু করুন। ভেদে বলা হয়েছে:
“ধর্ম এভ হতো হন্তি ধর্ম রক্ষতি রক্ষিতঃ” – যে ধর্মকে নষ্ট করে, ধর্মও তাকে নষ্ট করে। আর যে ধর্মকে রক্ষা করে, ধর্মও তাকে রক্ষা করে।