শাসন একটি গুরুদায়িত্ব। একজন শাসকের দায়িত্ব হলো প্রজাদের সুরক্ষা, সুখ-শান্তি এবং উন্নতি নিশ্চিত করা। বৈদিক ধর্মে শাসককে “রাজর্ষি” বা রাজা এবং ঋষির গুণাবলী ধারণকারী ব্যক্তি হিসেবে কল্পনা করা হয়। আপনি যদি বৈদিক শাসননীতি অনুসরণ করতে চান, তবে আমাদের জানা প্রয়োজন যে, একজন আদর্শ শাসকের কী গুণাবলী থাকা উচিত।
শাসকের প্রথম গুণ: সত্যনিষ্ঠতা
বৈদিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে,
“সত্যং ব্রুইয়াত প্রিয়ং ব্রুইয়াত, ন ব্রুইয়াত সত্যমপ্রিয়ম।”
অর্থাৎ, শাসককে সর্বদা সত্য কথা বলতে হবে, কিন্তু তা হতে হবে প্রীতিকর। শাসনের মূল ভিত্তি হলো সত্য। যদি শাসক মিথ্যা বলেন বা অন্যায় সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
আপনার জীবনে যদি শাসনের দায়িত্ব আসে, তবে আপনাকেও এই গুণটি অনুসরণ করতে হবে। যেমন ধরুন, মহাভারতে রাজা যুধিষ্ঠিরের কথা। তিনি সর্বদা সত্যের পথে ছিলেন এবং তার শাসনকালে প্রজারা ছিল সুখী ও নিরাপদ।
দ্বিতীয় গুণ: ন্যায়পরায়ণতা
শাসক হতে হবে ন্যায়ের প্রতীক। যজুর্বেদে বলা হয়েছে:
“অসতোমা সদ্গময়, তমসোমা জ্যোতির্গময়।”
অর্থাৎ, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাও—অন্যায় থেকে ন্যায়ের পথে যাও।
ন্যায়ের উদাহরণ দিতে গেলে রাজা রামের কথা বলা যায়। রামায়ণে তিনি নিজের প্রিয়জনদের বিরুদ্ধেও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে দ্বিধাবোধ করেননি। এই গুণটি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণ করা উচিত।
তৃতীয় গুণ: প্রজাসেবা
একজন শাসকের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রজাদের কল্যাণ করা। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে:
“সম গচ্ছধ্বং সম বদধ্বং, সম কোমনাংসিজন্তাম।”
অর্থাৎ, সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে এবং সমাজের উন্নতির জন্য মিলিত হতে হবে।
আধুনিক যুগে, একজন নেতা যদি মানুষের সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য কাজ করেন, তবে তিনি জনগণের হৃদয়ে স্থান পান। রাজা অশোক এই নীতিকে অনুসরণ করেছিলেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর তিনি প্রজাদের সুখ-শান্তির জন্য বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সমাজসেবা শুরু করেন।
চতুর্থ গুণ: ক্ষমাশীলতা
ক্ষমাশীলতা একজন শাসকের অন্যতম গুণ। মহাভারতে বলা হয়েছে:
“ক্ষমা ধর্মস্য মূলং।”
অর্থাৎ, ক্ষমা ধর্মের মূল ভিত্তি।
আপনি যদি ক্ষমা করতে জানেন, তবে প্রজারা আপনাকে শ্রদ্ধা করবে। রাজা বিক্রমাদিত্য ছিলেন এমনই একজন শাসক, যিনি অপরাধীদের প্রতি কঠোর হলেও প্রজাদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ছিলেন।
পঞ্চম গুণ: সাহস ও ধৈর্য
শাসককে হতে হবে সাহসী এবং ধৈর্যশীল। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে:
“উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্নিবোধত।”
অর্থাৎ, জাগ্রত হও, দাঁড়াও, এবং লক্ষ্যে পৌঁছাও।
রাজা চন্দ্রগুপ্ত মউর্যের কথা ভাবুন। তিনি তার সাহসিকতা এবং ধৈর্যের মাধ্যমে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সমাজে স্থিতি আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আমার এবং আপনার জীবনে প্রয়োগ
আপনি যখন একজন শাসক বা নেতা হিসেবে কাজ করেন, তখন এই গুণগুলো চর্চা করতে পারেন। হয়তো আপনার জীবনের কোনো পরিস্থিতি বা পেশাগত দায়িত্বে নেতৃত্বের প্রয়োজন হতে পারে। তখন সত্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, সেবা, ক্ষমাশীলতা এবং ধৈর্য আপনাকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।
শেষ কথা
শাসক শুধু একজন ব্যক্তি নয়, তিনি সমাজের প্রতিচ্ছবি। বৈদিক শাস্ত্র আমাদের শেখায় কিভাবে সঠিক পথ অবলম্বন করে সমাজকে উন্নত করা যায়। আপনি যদি শাসকের মতো এই গুণগুলো নিজের মধ্যে ধারণ করেন, তাহলে আপনি নিজের জীবনকে উন্নত করার পাশাপাশি সমাজকেও আলোকিত করতে পারবেন।