আপনার কি কখনো মনে হয়েছে যে জীবনের শান্তি, সুখ এবং সফলতার মূল চাবিকাঠি হলো আত্মসংযম? আমি নিশ্চিত, আপনি যদি আপনার জীবনকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে চান, তবে আত্মসংযম বা স্বনিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব বুঝতে পারবেন। ভেদিক জীবনধারার মূল একটি দিক হলো আত্মসংযম। এই গুণটি আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগ্রত করে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নতির পথ প্রশস্ত করে। আসুন, আজ আমরা এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি এবং বোঝার চেষ্টা করি, কেন আত্মসংযম এতটা গুরুত্বপূর্ণ।
আত্মসংযমের অর্থ
আত্মসংযম বলতে বোঝায় নিজের ইচ্ছা, আবেগ এবং প্রলোভনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা। এটি এমন একটি গুণ, যা আপনাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং আপনার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। ভেদান্তে বলা হয়েছে:
“ইন্দ্রিয়াণাং হি চরতাং, যন্নমনু বিদীয়তে। তদস্য হরতি প্রজ্ঞাং, বায়ুর্নাবমিভাম্ভসি।”
(ভগবদ্গীতা ২.৬৭)
অর্থাৎ, ইন্দ্রিয়সমূহ যদি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলে, তবে সেগুলি আমাদের মনের স্থিতি এবং প্রজ্ঞা ধ্বংস করে দেয়, যেভাবে বায়ু একটি নৌকাকে সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
আপনার ইন্দ্রিয় যদি আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকে, তবে আপনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্থিরতা অর্জন করতে পারবেন।
আত্মসংযমের গুরুত্ব
- মন ও দেহের শৃঙ্খলা বজায় রাখা:
আপনার মনে রাখতে হবে, শৃঙ্খলা ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। ভেদিক শিক্ষায় বলা হয়েছে যে আত্মসংযম আপনাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের পথে পরিচালিত করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনি নিয়মিত ধ্যান ও যোগ অভ্যাস করেন, তবে এটি আপনার মানসিক শান্তি বৃদ্ধি করবে। - মানসিক স্থিতি অর্জন:
আপনি কি জানেন, কেন অনেক সময় আমরা দ্রুত রেগে যাই বা হতাশ হয়ে পড়ি? কারণ, আমাদের ইন্দ্রিয় ও আবেগ আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। ভগবদ্গীতার আরেকটি শ্লোকে বলা হয়েছে:
“যঃ সম্প্রিয়ে চ দুঃখেষু, নোদ্বিগ্নমনা তথা। বীতরাগভয়ক্রোধঃ, স্থিতধীর্ মুনিরুচ্যতে।”
(ভগবদ্গীতা ২.৫৬)
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি সুখ-দুঃখে সমান থাকে এবং রাগ-ভয় থেকে মুক্ত, সে স্থিতপ্রজ্ঞ মুনির মতো।
আপনি যদি রাগ এবং হতাশা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চান, তবে আত্মসংযম চর্চা করতে হবে।
- লক্ষ্য অর্জনের পথে সহায়ক:
আপনার জীবনের লক্ষ্য কী? সেটা যাই হোক না কেন, তা অর্জনের জন্য আপনাকে ইচ্ছাশক্তি ও নিয়মানুবর্তিতা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, একজন ছাত্র যদি নিজের পড়াশোনার প্রতি নিয়মিত মনোযোগ দেয়, তবে সে সফল হতে বাধ্য।
আত্মসংযমের ভেদান্তিক উদাহরণ
- পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা:
কল্পনা করুন, আপনি একজন ছাত্র। আপনার সামনে মোবাইল ফোন এবং একটি পড়ার বই। আপনি যদি ফোনে সময় নষ্ট করেন, তবে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়বেন। কিন্তু আত্মসংযমের মাধ্যমে যদি বইটি পড়ার জন্য মনোনিবেশ করেন, তবে আপনি অবশ্যই ভালো ফল পাবেন। - খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ:
আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস আপনার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। আত্মসংযমের মাধ্যমে সুষম খাদ্য গ্রহণ করলে শরীর ও মন উভয়ই সুস্থ থাকবে। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে:
“দীর্ঘায়ুং ধাতুমুচ্চ্যতে।”
অর্থাৎ, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা দীর্ঘায়ুর পথ প্রশস্ত করে।
- আর্থিক নিয়ন্ত্রণ:
অতিরিক্ত খরচ আমাদের আর্থিক স্থিতি নষ্ট করে। আপনি যদি বাজেট করে খরচ করেন এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন, তবে আর্থিক উন্নতি সম্ভব।
আত্মসংযম চর্চার পদ্ধতি
- ধ্যান ও প্রার্থনা:
আপনি কি জানেন, ধ্যান এবং প্রার্থনা আত্মসংযম শেখার সর্বোত্তম উপায়? প্রতিদিন সকালে অন্তত ১০ মিনিট ধ্যান করুন। এটি আপনার মনকে শান্ত করবে এবং আত্মসংযমের শক্তি বৃদ্ধি করবে। - সংযমিত ভাষা চর্চা:
আপনার কথা যদি নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে সম্পর্কগুলো আরো মজবুত হয়। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে:
“সত্যং ব্রূয়াত, প্রিয়ং ব্রূয়াত।”
অর্থাৎ, সত্য কথা বলুন, তবে তা যেন প্রিয় হয়।
- যোগাসন:
যোগ চর্চা শুধু শারীরিক নয়, মানসিক সংযমও শিখায়। প্রতিদিন যদি ১৫-২০ মিনিট যোগব্যায়াম করেন, তবে আপনার ইন্দ্রিয়গুলি সহজেই নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
উপসংহার
আত্মসংযম চর্চার মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনে শান্তি, স্থিতি এবং সফলতা আনতে পারি। এটি আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতিরও প্রধান সোপান। তবে মনে রাখবেন, এটি একটি ধাপে ধাপে অর্জন করার প্রক্রিয়া। আজ আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, নিজেকে প্রশ্ন করুন: আমি কি আমার ইন্দ্রিয় এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি? যদি উত্তর না হয়, তবে এখনই শুরু করুন।