অহিংসা নীতি কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে?

অহিংসা শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে প্রথমেই যা আসে তা হলো, “হিংসার অনুপস্থিতি।” তবে অহিংসা নীতির গভীরতা শুধুমাত্র হিংসার পরিহারে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি জীবনপদ্ধতি। আপনি যদি বেদ এবং প্রাচীন ভারতীয় দর্শন থেকে জীবনের অর্থ অন্বেষণ করেন, তাহলে অহিংসা আপনার জন্য একটি শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি হতে পারে।

বেদের শিক্ষায় বলা হয়েছে, “অহিংসা পরম ধর্ম।” এর অর্থ হলো, শুধু ভৌত হিংসা থেকে বিরত থাকা নয়, বরং চিন্তা, বাক্য, ও কর্মে সকল জীবের প্রতি মঙ্গলভাব পোষণ করা। আজকের এই আলোচনায় আমি আপনাকে অহিংসার তাৎপর্য বোঝাতে এবং এটি আপনার জীবনে কীভাবে প্রয়োগ করবেন তা ব্যাখ্যা করব।

অহিংসার তাৎপর্য বেদে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে?

বেদের বিভিন্ন মন্ত্রে অহিংসার গুরুত্ব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঋগ্বেদে উল্লেখ রয়েছে:

“মিত্রস্য চক্ষুষা সর্বাণি ভূতানি সংদদ্বম।”

এর অর্থ হলো, “মিত্রের দৃষ্টিতে সব জীবকে দেখো।” এটি আমাদের শেখায় যে আমরা প্রত্যেক জীবের মধ্যে সৌহার্দ্য ও মিত্রভাব গড়ে তুলব। এই চিন্তাধারা শুধুমাত্র মানুষের সঙ্গে নয়, প্রাণী, উদ্ভিদ, এবং প্রকৃতির প্রতিটি সত্তার প্রতিও প্রযোজ্য।

আপনি যদি আপনার চিন্তাধারা এবং কাজের মাধ্যমে অহিংসা অনুশীলন করেন, তবে এটি আপনার মনকে প্রশান্তি দেবে এবং সমাজে শান্তি স্থাপন করবে। বেদে আরও বলা হয়েছে:

“সত্যম বৃতং অহিংসা পরম ধর্ম।”

অর্থাৎ, সত্য এবং অহিংসা মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ নীতি হওয়া উচিত।

অহিংসার উদাহরণ

১. মহাত্মা গান্ধীর জীবন:

গান্ধীজির জীবন অহিংসার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি বলেন, “অহিংসা আমার ধর্ম এবং এটি আমার জীবনের দর্শন।” ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি অহিংসার মাধ্যমে যে আন্দোলন চালিয়েছিলেন, তা আজও বিশ্বের কাছে এক অনন্য উদাহরণ।

২. প্রকৃতি এবং পরিবেশ রক্ষা:

আপনি যদি গাছ কাটা বন্ধ করেন এবং প্রকৃতিকে রক্ষা করেন, সেটাও অহিংসার একটি রূপ। প্রকৃতির প্রতি হিংসা মানে হলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি হিংসা। উদাহরণস্বরূপ, গাছ লাগানো বা জল সংরক্ষণ করার মাধ্যমে আমরা প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করতে পারি।

৩. প্রাণীর প্রতি দয়া:

আপনার দৈনন্দিন জীবনে নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে অহিংসার পথে। বেদে বলা হয়েছে,

“মা হিংস্যৎ সর্বাণি ভূতানি।”

অর্থাৎ, “কোনো জীবকে কষ্ট দিও না।”

৪. মানবিক আচরণ:

আপনি যখন কাউকে সহায়তা করেন বা কারো কষ্ট দূর করেন, তখন আপনি অহিংসার চর্চা করেন। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিবেশী বা বন্ধুর প্রতি সহানুভূতি দেখানো এবং তাদের কষ্টের মুহূর্তে পাশে থাকা।

৫. মনে ও কথায় অহিংসা:

অনেক সময় আমরা কথায় বা ভাবনায় অন্যকে আঘাত করি। বেদে বলা হয়েছে,

“মনস্যেকম বচস্যেকম কর্মণ্যেকম মহাত্মানাম।”

অর্থাৎ, “মহৎ ব্যক্তি তাদের চিন্তা, কথা এবং কাজকে এক করে রাখেন।” চিন্তা, বাক্য এবং কাজে একাত্মতা রক্ষা করে আমরা অহিংসার পথে চলতে পারি।

জীবনে অহিংসা প্রয়োগের উপায়

১. নিজেকে ক্ষমা করতে শিখুন

অহিংসার প্রথম ধাপ হলো নিজের প্রতি মমত্বশীল হওয়া। আমরা প্রায়ই নিজের ভুলগুলিকে ক্ষমা করতে পারি না। এটি আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে। নিজেকে ক্ষমা করা শিখুন এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলুন।

২. অন্যের প্রতি দয়া

আপনি কি কখনো ভেবেছেন, আপনার এক ছোট্ট সহানুভূতিশীল কাজ অন্যের জীবনে কতটা পরিবর্তন আনতে পারে? একজন ভিক্ষুককে খাবার দেওয়া বা কাউকে মানসিক সমর্থন দেওয়া অহিংসার এক সুন্দর উদাহরণ।

৩. প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ

আপনি যদি জল, বিদ্যুৎ বা অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় বন্ধ করেন, তবে এটি আপনার চারপাশের পরিবেশের প্রতি অহিংসার একটি চর্চা।

৪. দৈনন্দিন জীবনে ধৈর্যশীলতা

অনেক সময় আমরা পরিস্থিতির চাপে রাগান্বিত হয়ে যাই এবং কটু কথা বলি। আপনার রাগ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে আপনি অহিংসার পথকে বেছে নিতে পারেন।

৫. পশুপাখির প্রতি দয়া

আপনার বাড়ির আশেপাশে পশু বা পাখি থাকলে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন। আপনি যদি তাদের জন্য জল ও খাবারের ব্যবস্থা করেন, তাও অহিংসার একটি রূপ।

বেদ থেকে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য উক্তি

১. “সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ।”
এর অর্থ, “সবাই সুখী হোক।”

আপনার প্রতিদিনের আচরণ যদি এই ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়, তবে আপনি একজন সত্যিকার অহিংসা অনুশীলনকারী হবেন।

২. “ধারণাৎ ধর্ম ইত্যাহু।”
এটি বোঝায় যে ধর্মের অর্থ হলো যা ধারণ করা যায়। অহিংসা এমন একটি নীতি যা সব জীবের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলে।

৩. “যত্র বিশ্বং ভবত্যেক নিড়ম।”
অর্থাৎ, “যেখানে সারা বিশ্ব এক পরিবার।” এটি আমাদের শেখায় যে অহিংসার চর্চা আমাদেরকে একত্রিত করে।

অহিংসার মাধুর্যে জীবনের সমৃদ্ধি

আপনি যখন অহিংসা নীতি মেনে চলবেন, তখন আপনার জীবনে শান্তি, সুখ এবং স্থিতিশীলতা আসবে। অহিংসা আমাদের অন্তরকে নির্মল করে তোলে এবং আমাদের অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে। বেদে অহিংসার গুরুত্বের কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে কারণ এটি এক বৈশ্বিক সাদৃশ্য গড়ে তোলে।

তবে, প্রশ্ন হলো, আপনি কি প্রতিদিন আপনার কাজ এবং চিন্তায় অহিংসার চর্চা করতে প্রস্তুত? আপনি যদি এই মহৎ নীতিকে গ্রহণ করেন, তবে শুধু আপনার জীবনই নয়, বরং সারা সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

শেষ কথা:

বেদে বারবার বলা হয়েছে, “অহিংসা হলো সর্বোচ্চ ধর্ম।” আপনি কি এই ধর্মকে জীবনের পথনির্দেশক হিসাবে গ্রহণ করবেন? আপনার প্রতিটি কাজ কি এই মহান নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *