কীভাবে সমাজের সর্বস্তরে অর্থনৈতিক সাম্য আনা সম্ভব?

অর্থনৈতিক সাম্যের প্রশ্নটি আমাদের সমাজে চিরকালই প্রাসঙ্গিক। আপনি কি কখনো ভেবেছেন, কেন সমাজে কেউ থাকে অঢেল সম্পদের মালিক, আবার কেউ দিন কাটায় দুমুঠো অন্নের অভাবে? যদি আমি বলি, এই সমস্যার সমাধান আছে প্রাচীন বেদে, তাহলে আপনি কি আগ্রহী হবেন? আসুন, আমরা একসাথে বেদের আলোকে এই সমস্যার সমাধান খুঁজি।

বেদের দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক সাম্য

বেদে বলা হয়েছে, “সম গচ্ছধ্বং সম বদ্ধ্বং সম বা মনांसি জানতাম।” (ঋগ্বেদ ১০.১৯১.২) অর্থাৎ, সবাই মিলে একসঙ্গে চল, একই লক্ষ্যে মনোনিবেশ কর। অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপটি হলো একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া এবং সহযোগিতার মানসিকতা গড়ে তোলা।

 জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা

বেদ বলে, “সর্বং জ্ঞানময়ং জগত।” (অথর্ববেদ ১৯.৪১) জ্ঞানই পৃথিবীর আসল সম্পদ। যদি আপনি এবং আমি সমাজের প্রত্যেককে শিক্ষার অধিকার প্রদান করতে পারি, তাহলে তারা নিজেরাই জীবিকার পথ খুঁজে নিতে সক্ষম হবে। এক উদাহরণ দিই—আমার এক বন্ধু ছোটো একটি গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেই স্কুলে গ্রামীণ শিশুদের আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি কৃষি এবং কুটিরশিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখন সেই গ্রামটি আর দরিদ্র নয়; প্রত্যেকে স্বনির্ভর।

 সমান সুযোগ সৃষ্টি করা

অর্থনৈতিক সাম্যের জন্য সমাজে সমান সুযোগ থাকা আবশ্যক। বেদে বলা হয়েছে, “ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগত।” (ঈশোপনিষদ ১) অর্থাৎ, পৃথিবীর সব কিছুই ঈশ্বরের সৃষ্টি, এবং তাই তা সবার জন্য। আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, সমাজের অনেক মানুষ সঠিক সুযোগের অভাবে পিছিয়ে পড়ে? যদি আপনি একটি ছোটো উদ্যোগ নিয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষদের প্রশিক্ষণ ও সুযোগ দেন, তাহলে তারা দ্রুত উন্নতি করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, আমাদের দেশের কিছু স্থানীয় সরকার নারী ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন করেছে। তাঁরা মাইক্রোফাইন্যান্স, কুটিরশিল্প এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করেছেন। আপনি নিজেও এমন একটি উদ্যোগ নিতে পারেন।

 প্রাকৃতিক সম্পদের সুষম বণ্টন

বেদে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার সম্পর্কে বলা হয়েছে, “মাতা ভূমি: পুত্রোহং পৃথিব্যা:” (অথর্ববেদ ১২.১.১২) অর্থাৎ, এই পৃথিবী আমাদের মা, এবং আমরা তার সন্তান। মা যেমন তার সন্তানদের মধ্যে সমানভাবে সবকিছু ভাগ করে দেন, তেমনি আমাদেরও প্রাকৃতিক সম্পদ সুষমভাবে ব্যবহার করতে হবে।

আজকের দিনে খনিজ তেল, বনজ সম্পদ, এবং জলাশয়ের ওপর একচেটিয়া দখলদারিত্ব অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করছে। আমি একবার একটি গ্রামে গিয়েছিলাম, যেখানে স্থানীয় কৃষকদের জল সংরক্ষণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। ফলাফল? সেচের জন্য জল সহজলভ্য হওয়ায় তাদের কৃষি উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে।

 দানশীলতা ও আত্মসংযম

বেদে দান ও আত্মসংযমের ওপর অত্যন্ত জোর দেওয়া হয়েছে। “ত্যাগেন ভুঞ্জীথাঃ।” (ঈশোপনিষদ ১) অর্থাৎ, ত্যাগের মধ্য দিয়েই প্রকৃত আনন্দ লাভ করা যায়। আপনি কি জানেন, ধনীদের অল্প একটু দানও দরিদ্রদের জীবন আমূল বদলে দিতে পারে?

আপনি নিজেও এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন। যেমন, আপনার ব্যবহার করা জিনিসগুলি অন্যের প্রয়োজন মেটাতে দান করতে পারেন। অথবা একটি ফান্ড তৈরি করে দরিদ্রদের জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে পারেন।

 সামাজিক সমবায় গঠন

বেদে সামূহিক উদ্যোগ এবং সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে, “সহ নৌ যশঃ সহ নৌ ভুঞ্জ্যাঃ।” (ঋগ্বেদ ১.৮৯.১) অর্থাৎ, আমরা একে অপরের সফলতায় আনন্দ ভাগ করব। আমাদের সমাজে সমবায়ের ধারণা জাগিয়ে তুলতে হবে।

একটি সমবায় উদ্যোগের কথা বলি—আমার এক পরিচিত গ্রামে মহিলারা মিলে একটি দুধ সমবায় তৈরি করেছেন। সবাই তাদের গৃহপালিত পশুদের দুধ এখানে বিক্রি করেন, এবং মুনাফা ভাগ করে নেন। এই উদ্যোগে প্রত্যেকেই আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন।

আপনার ভূমিকা

আপনি যদি সত্যিই বেদের আদর্শে সমাজ পরিবর্তন করতে চান, তাহলে আপনাকেই প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে। আপনি নিজের চারপাশের মানুষের সমস্যা দেখুন। ভাবুন, কিভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পারেন। একটি ছোটো উদ্যোগও বড়ো পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।

সমাপ্তি

বেদের শিক্ষা আমাদের দেখায়, অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা শুধু সম্ভব নয়, এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তবে, আপনি কি প্রস্তুত এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে? আপনার সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে সমাজের ভবিষ্যৎ। বেদের এই অমর বাণী মনে রাখুন—“কৃতস্য ন নাস্তি প্রত্যবায়:” (ঋগ্বেদ ৪.৩২.২৩), অর্থাৎ, ভালো কাজের কোনো ফল কখনো হারিয়ে যায় না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *